প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বিয়ের খরচ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাজেটে বিয়ের প্রসাধনীতে ১৭ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বিদেশি কসমেটিকস আমদানিতে আগে শুল্ককর ছিল ৩ শতাংশ। এখন থেকে তা হবে ২০ শতাংশ। এতে করে বিদেশি সাবান, অর্গানিক সার্ফেস অ্যাক্টিভ উপকরণ, বার কেক ও বিভিন্ন সাবান তৈরির উপকরণ, ওয়াশিং ক্রিম, ডিটারজেন্ট, লিকুইড সাবান, লিকুইড ক্রিম এবং বিয়ের উপকরণের দাম বাড়বে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন নুরুল ইসলাম । বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তাদের পরিচয়। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্কে আছেন তারা। তাদের এই সম্পর্কের কথা জানে দুই পরিবারই। বিয়ের জন্য চাপও দেওয়া হচ্ছে পরিবার থেকে। কিন্তু শিগগিরই বিয়ে করতে চান না তারা।
কেন করতে চাচ্ছেন না জানতে চাইলে ইসলাম বলেন, হুটহাট চাইলেই তো আর বিয়ে করা যায় না। অনুষ্ঠান করতে হয়, পোশাক কিনতে হয়, গহনা কিনতে হয়। আরও কত খরচ আছে। হাতে কিছু টাকা না জমিয়ে তো আর বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমরা দুজনই সিদ্ধান্তৃ নিয়েছি ভালো ক্যারিয়ার গড়ে তারপর বিয়ে করব। যেন স্বাচ্ছন্দ্যে বিয়ের আয়োজন করতে পারি। এমন কথা আরও অনেক প্রেমিকযুগলই বলেছেন। সবার প্রায় একই কথা, বিয়েতে অনেক খরচ। ভালো ক্যারিয়ার না গড়ে বিয়ে করার চিন্তা করছেন না তারা।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বশির উদ্দিন বলেন, আমাদের কেনাবেচা নেই, আয় নেই, এমনিতেই কষ্টের মধ্যে আছি। তার ওপর বিয়ের প্রসাধনীতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলে ব্যবসায়ীরা আরও চাপের মুখে পড়বে। শুল্ক বাড়লে তো স্বাভাবিকভাবে পণ্যের দামও বেড়ে যাবে তখন কেনাবেচা আরও কমে যাবে। আর মানুষ কিনবেই বা কি দিয়ে তাদের হাতে তো আর টাকা নেই। টাকা আছে বড় বড় ব্যবসায়ী, আমলাদের কাছে। তারা সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধাও পেয়ে থাকে। তিনি বলেন, বৈধ আমদানিকারকরা লাগেজ ব্যবসায়ীদের কারণে এমনিতেই চাপে আছে। লাগেজ ব্যবসায়ীরা কম শুল্ক দিয়ে বিদেশি পণ্য আনেন। আর বৈধ আমদানিকারকরা পুরো শুল্ক পরিশোধ করে পণ্য আমদানি করেন। এখন অতিরিক্ত ১৭ শতাংশ শুল্কের কারণে লাগেজে বিদেশি আমদানি বেড়ে যাবে। যারা বৈধ পথে আমদানি করে তারা আরও চাপে পড়ে যাবে।
কুইন পার্লার অ্যান্ড স্পা সেন্টারের কর্ণধার আতিয়া মনির বলেন, ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি খুলছে না। যার ফলে এখন অনেক প্রসাধনীই দেশের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। যেগুলো পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি আগের মূল্যেই ক্রেতাদের সেবা দিতে। তারপরও কিছু সেবার মূল্য বাধ্য হয়েই বাড়াতে হচ্ছে। এতে আমাদের ক্রেতাও কমে যাচ্ছে। যারা আসছে তারাও তুলনামূলকভাবে কম সাজগোজ করছেন। এখন নতুন করে যদি শুল্ক বাড়ানো হয় তা হলে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।
বিয়েতে ব্যবহৃত পোশাক, গহনা, প্রসাধনী, জুতা, স্যান্ডেলসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে বিয়ের খাবার খরচও বেড়েছে। কারণ পোলাও চাল, ভোজ্য তেল, ঘি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, গরু, মুরগি এবং সব ধরনের মিষ্টির দামও বেশি। বিয়ের দাওয়াত কার্ড আগের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। গাড়ি ভাড়া এবং ফুলের দাম থেকে শুরু করে আলোকসজ্জার খরচও বেড়েছে।
কনে সাজের অন্যতম উপাদান গহনা। আর গহনার উপকরণ স্বর্ণের দামও আকাশচুম্বী। বর্তমানে ভালো মানের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ৯৮ হাজার ৪৪৪ টাকা।
মূল্যবান এই ধাতুর দাম বেড়েই চলছে। ২০১৯ সালে ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের দাম ছিল প্রতি ভরি ছিল ৪৭ হাজার ৪৭২ টাকা। আর ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৩৬১ টাকা। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির তথ্য মতে, ২০০০ সালের দিকে স্বর্ণের দাম ভরিতে ছিল ৬ হাজার ৯০৬ টাকা। ২০১০ সালে ৪২ হাজার ১৬৫ টাকায় ঠেকে।
অন্যদিকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন (বিধিমালা), ২০০৯’ সংশোধন করে বিয়ে নিবন্ধন ও তালাকের ফি বাড়ানো হয়েছে। এখন একজন নিকাহ রেজিস্ট্রারকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহরের ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার টাকা দেনমোহর বা এর অংশবিশেষের জন্য ১৪ টাকা হারে বিবাহ নিবন্ধন ফি দিতে হবে। আগে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহরের ক্ষেত্রে ১২ টাকা ৫০ পয়সা হারে রেজিস্ট্রার বা কাজিকে ফি দিতে হতো।
বর্তমানে দেনমোহরের পরিমাণ ৫ লাখ টাকার বেশি হলে পরের প্রতি লাখের জন্য ১০০ টাকা ফি দিতে হবে। তবে দেনমোহরের পরিমাণ যাই হোক না কেন ২০০ টাকার কম ফি দেওয়া যাবে না।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে বিয়ের ওপর কর আদায়ের পরিকল্পনা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও (ডিএসসিসি)। সিটি করপোরেশন আদর্শ কর তফসিল ২০১৬-এর ১৫২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রথম বিয়ে বা প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর আবারও বিয়ে করার জন্য বরকে ১০০ টাকা কর দিতে হবে। প্রথম স্ত্রীর জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বিয়ের জন্য বরকে ৫ হাজার টাকা এবং প্রথম দুই স্ত্রীর জীবদ্দশায় তৃতীয় বিয়ের জন্য ২০ হাজার টাকা কর দিতে হবে।’
তফসিল অনুযায়ী, একই ধারায় চতুর্থ বিয়ের জন্য বরকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। স্ত্রী মানসিক ভারসাম্যহীন হলে বা সন্তানহীন হলে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী বিয়ের জন্য বরকে ২০০ টাকা কর দিতে হবে।