আত্মনির্ভরশীল, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের দাবি জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। আজ (১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪) মহান বিজয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষ্যে চবি আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ আহবান জানান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে মহাসমারোহে ও আনন্দঘন পরিবেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে মহান বিজয় দিবস ২০২৪ উদযাপিত হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ সন্ধ্যা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্য, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, স্মরণ চত্বর ও বিভিন্ন হলসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সকল গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১২:০১ মিনিটে বিজয় দিবসের সূচনালগ্নে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিএনসিসির উদ্যোগে স্বাধীনতা স্মারক ভাস্করে্য বিউগলের সুরে শহীদদের স্মরণ করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০:০০ টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা স্মারক ভাস্করে্য চবি উপাচার্য, উপ-উপাচার্যদ্বয়, অনুষদসমূহের ডিন, রেজিস্ট্রার ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়ে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে লাখো শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
পুস্পার্ঘ অর্পণ শেষে সকাল ১০:৩০ টায় মাননীয় উপাচার্যের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় বিজয় বিজয় র্যালি। র্যালিটি স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্য চত্বর থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে চবি সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়। চবি সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ মিলনায়তনে বেলা ১১:০০ টায় “বর্তমান বাংলাদেশে বিজয় দিবসের তাৎপর্য” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভার প্রধান অতিথি চবি উপাচার্য বলেন, যে ঐক্য নিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা বাংলাদেশীরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, একটি রাজনৈতিক দল সে অর্জনকে লুটপাট ও অত্যাচার চালিয়ে ম্লান করে দিয়েছে। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা সরকার একই কায়দায় দূনীতি, অর্থ পাচার, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশের সাধারণ মানুষের কন্ঠ রোধ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। জুলাই-আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে এ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তিনি আরও বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আমাদেরকে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংস্কারের অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এ সুযোগ আমাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, আজকের এ মহান বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের এক অনন্য মাইলফলক। এ দিন আমাদের ত্যাগ, সাহস ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিজয় দিবসের তাৎপর্য আমাদের কাছে বহুমাত্রিক।
চবি মাননীয় উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেন, দেশ স্বাধীন করলাম আমরা আপামর জনতা, কিন্তু সেখানে আমরা দেখি ৯৩ হাজার সেনাবাহিনীকে নিয়ে পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী ভারতীয় জেনারেল অরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করেন। কেন সেদিন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সবার্ধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীকে রাখা হয়নি? এ প্রশ্নের উত্তর আমি সারা জীবন খুঁজে পাইনি। আমরা দেখেছি এম.এ.জি. ওসমানীর নাম নিশানা পর্যন্ত এতদিন স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে ছিলনা। এর অজ্ঞাত কারণ আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ভারতীয় বংশোদ্ভুত শর্মিলা বসুর থিসিস ‘ডেড রেকনিং’ এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ বিতর্ক পরিসমাপ্তির জন্য বাংলাদেশের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশের জন্য বর্তমান সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের প্রতি বিনীত আহবান জানান। তিনি আরও বলেন, ভারতের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তিনি ভারত সরকারের নিকট এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে দেখানোর অনুরোধ জানান। মাননীয় উপ-উপাচার্য বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা-অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য মৌলিক সংষ্কার চান এবং একটি একমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও সকল বিভাগীয় শহরে আন্তজার্তিক মানের হাসপাতাল গড়ে তোলার জন্য বর্তমান সরকারের প্রতি আহবান জানান।
চবি মাননীয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মোঃ কামাল উদ্দিন বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার সাড়ে পনের বছর দেশের সাধারণ মানুষকে উন্নয়নের গল্প শুনিয়েছিল। তারা উন্নয়নের নামে করেছে লুটপাট। তিনি আরও বলেন, বিগত সরকারের অত্যাচার, জুলুম, নিযার্তন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকেও হার মানিয়েছে। ফ্যাসিবাদীরা নিজেরা খায় এবং অন্যদেরকেও খাওয়ায়। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে বিগত সময়ে আমাকে আদালতের কাড়গড়ায় দাড়াঁতে হয়েছে। তারপরও আমি ন্যায়ের পক্ষে কলম ধরা থেকে পিছপা হইনি। তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সমন্বয়কদের দাবির প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে চাকসু ও বিভিন্ন হলের ছাত্র প্রতিনিধি নিবার্চনের ঘোষণা দেন। একইসাথে শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণের ঘোষণা প্রদান করেন। মাননীয় উপ-উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সকল মহলের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।
ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন প্রফেসর এস. এম. নসরুল কদির বলেন, বিজয়ের এ দিন সশস্ত্র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পনের দিন, দীর্ঘ নয় মাস লড়াই-সংগ্রাম করে বিজয় ছিনিয়ে আনার দিন। তাই এ বিজয় অত্যন্ত আনন্দের ও গৌরবের। বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনার মধ্যদিয়ে অর্জিত হয়েছে বাঙালির স্বাধীনতা, সম্মান ও একটি লাল-সবুজের পতাকা। স্বাধীনতার ৫২ বছরে আমরা অনেক সাফল্য অর্জন করেছি। অর্থনীতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি আজ সারা বিশ্বে প্রশংসিত। তবে, আমাদের সামনে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, নতুন বাংলাদেশে আমরা অনেক বেশি আশাবাদী। ২৪ এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন আমাদেরকে এ আশাবাদী হওয়ার অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এজন্য তিনি তাদেরকে ধন্যবাদ জানান। তিনি চবি উপাচারে্যর সম্মোহনী নেতৃত্বে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করার আহবান জানান।
চবি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ৭১ এবং ২৪ কে মুখোমুখি করার নিন্দা জানান। ৭১ এর যুদ্ধের ডাক ছিল শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে। অনুরূপভাবে ২৪ এর সংগ্রামও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সুতরাং যারা ৭১ দ্বারা ২৪ কে মুছে দিতে চায় অথবা ২৪ দ্বারা ৭১ কে মুছে দিতে চায়, তারা মূর্খ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফির বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেন। রেজিস্ট্রার বলেন, ‘১৯৭১ এবং ২০২৪ পরস্পরের পরিপূরক। তিনি এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানান। এ ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যাবেনা। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি জেনারেল অরোরার সাথে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের সময় কেন সেদিন এম.এ.জি. ওসমানীকে রাখা হয়নি সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে লাখ লাখ বাংলাদেশী প্রাণ হারিয়েছে। অথচ যুদ্ধেও শেষ দিকে এসে ভারত এ যুদ্ধকে ভারত-পকিস্তান যুদ্ধ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সবার্ধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীর অবস্থানটি জেনারের অরোরা দখল করে নেয়। এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হাইজ্যাক হওয়ার শামিল বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে প্রকৃত রহস্য আমাদের বের করতে হবে। চবি রেজিস্ট্রার ২৪ এর গণআন্দোলনে শহীদদের স্মরণ করেন এবং এ আন্দোলনে সমন্বয়কদের ভূয়ঁসী প্রশংসা করে বলেন, গত পনের/ষোল বছরে দেশের রাজনীতিবিদগণ যা করতে পারেনি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা সফলভাবে তা করে দেখিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক সমন্বয়ক প্রফেসর ড. মোঃ এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য আলোচনা করে বলেন, এদেশের মানুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার জন্য। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেই মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২৪ এর বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলনের ফলে মানুষের সে সামাজিক মর্যাদা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে অভূতপূর্ব সুযোগ হয়েছে। এ সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, আসুন আমরা বৈষম্য পরিহার করে দেশ-জাতির কল্যাণে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করি। একই সাথে তিনি বিগত সময়ে দেশের সাধারণ মানুষ যে বৈষম্যের শিকার হয়েছে, সে বিষয়ে একটি কমিটির গঠনের জন্য সরকারের নিকট আহ্বান জানান।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক আন্দোলনের সমন্বয়ক চবি জীব বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোঃ আতিয়ার রহমান বলেন, প্রেম ও দ্রোহ একসাথে চলে না। স্বাধীনতার জন্য প্রেম ও দ্রোহ একসাথে চলে। তিনি আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালের মহান বিজয় পরবর্তীতে ব্যর্থ হয়েছে। ৭১ এর পরবর্তী ক্ষমতার বরপুত্ররা দেশের মানুষের যৌথ খামারগুলো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল। তখন আমাদের দুঃখ বেদনাগুলো জানানোর মত কেউ ছিলনা। ২৪ এর গণআন্দোলনের পর এখনো পর্যন্ত আমাদের দুঃখগুলো কেউ জানতে চাইলো না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, ২৪ এর গণ-আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের বিবেক বন্ধক দিয়েছিলেন। তিনি সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সবসময়ই শিক্ষার্থীদের সাথে রাজপথে থাকার ঘোষণা দেন। তিনি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ২৪ কে ধারণ করে সকলকে জাগ্রত থাকার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠান সঞ্চালক ও চবি প্রক্টর প্রফেসর ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ বলেন, ২৪ এর গণআন্দোলনের ফলে যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ এসেছে, সেটাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন জাতিকে বিকৃত করার প্রশাসন নয়। ছাত্রদের অধিকার ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে বর্তমান প্রশাসন বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে বর্তমান প্রশাসন ইতোমধ্যে ছাত্রবান্ধব বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতাসহ সংশ্লিষ্টদের এ দেশকে নতুন করে গড়তে অগ্রণী ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
চবি ছাত্র-ছাত্রী নির্দেশনা ও পরামর্শ কেন্দ্রের পরিচালক ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এবং ২৪ শে বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলনে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, শোষণহীন ও বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা। কিন্তু সে লক্ষ্য আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমাদের বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবারের অবস্থা কি কেউ কখনো খবর নিয়েছেন? তথ্য নিয়ে জানা গেছে, বেশ কয়েকজন বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের অবস্থা করুণ। তারা নামে মাত্র ভাতা ছাড়া আর কোন সুযোগ সুবিধা রাষ্ট্র থেকে পাচ্ছেন না। তাদের পরিবারের প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে। তিনি বর্তমান সরকারের প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রকাশের আহ্বান জানান। একই সাথে ২৪ এর গণআন্দোলনের ফলে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকলকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে কাজ করার আহ্বান জানান।
চবি শামসুন্নাহার হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. বেগম ইসমত আরা হক ১৯৭১ এবং ২০২৪ এর গণআন্দোলনে সকল শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। তিনি বলেন, ‘মহান বিজয় দিবসের আলোচনা আমাদের পাথেয়। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ আমরা সকলে একতাবদ্ধ থাকবো মর্মে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
চবি রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. এ কে এম মাহফুজুল হক (মাহফুজ পারভেজ) বলেন, বিজয় একটি চিরন্তন ও শাশ্বত বিষয়। আমরা ১৯৪৭ সালে উপনিবেশিকদের কাছ থেকে বিজয় অর্জন করেছি। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন বিজয় পেয়েছি। এর ফলে বাংলাদেশ আবার মূল স্রোতে ফিরে এসেছে। তিনি শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক পথে আনার আহ্বান জানান। একই সাথে সকল ধরনের দুর্নীতিকে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানান।
চবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি জনাব মোহাম্মদ আজহার বলেন, আমাদেরকে ৭১ এবং ২৪ এ দুটোকেই ধারণ করতে হবে। তিনি ৭১ এর মত ২৪ এর ইতিহাস বিকৃত না করার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন ২৪ এর ইতিহাস প্রাসঙ্গিক। এ দেশের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোন শাসক এদেশের মানুষকে পরাধীন করে রাখতে পারেনি। এদেশের মানুষ স্বাধীনচেতা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহ সমন্বয়ক জনাব খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা রক্ত দিয়ে সাম্য, ন্যায় ও সমতার জন্য এ দেশকে স্বাধীন করেছিল। কিন্তু আমরা সে সাম্য, ন্যায় ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার সাড়ে ১৫ বছর এদেশের সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে। তিনি যারা ৭১ দ্বারা ২৪ কে মুছে দিতে চায় অথবা ২৪ দ্বারা ৭১ কে মুছে দিতে চায় তারা মূর্খ বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, দিল্লির প্রেসক্রিপশন ছাড়া বাংলাদেশ চলেনা। এ সংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি অন্তবর্তীকালীন সরকারকে সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের আহ্বান জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চবি সমন্বয়ক জনাব রাসেল আহমদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বলেন, সাম্য, ন্যায় এবং বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের অধিকার গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ে বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে দেশের চৌকস ও মেধাবী আর্মি অফিসারদের হত্যা করা হয়েছে। মানুষের রাজনৈতিক অধিকার, ভোটাধিকারসহ বিভিন্ন অধিকার হরণ করা হয়েছিল। তিনি অপরাজনীতি ও বিভিন্ন দলাদলি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের অংশগ্রহণকারী চবি ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষার্থী প্রিয়াঙ্কা পিংকি বলেন, ২৪ এর জুলাই- আগস্ট গণআন্দোলনের ফলে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। দেশ গড়ার এ সুযোগ আমাদের ধরে রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভালো চলুক এটা আমরা চাই। এই ক্যাম্পাসে আমরা স্বাধীনভাবে পড়ালেখা করতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে আমরা সব সময় প্রস্তুত রয়েছি।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন চবি অফিসার সমিতির সভাপতি রশিদুল হায়দার জাবেদ, চবি কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জনাব মোঃ মনছুর আলী, চবি কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি জনাব মোহাম্মদ আলী হোছাইন।
সভায় শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মুনাজাত পরিচালনা করেন চবি তথ্য ও ফটোগ্রাফি শাখার প্রশাসক ড. মোঃ শহীদুল হক। পুস্পার্ঘ অর্পণ করে লাখো শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন কার্যক্রম পরিচালনা করেন চবি তথ্য ও ফটোগ্রাফি শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার জনাব মোহাম্মদ হোসেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে মাননীয় উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) এর পর চবি স্বাধীনতা স্মারক ভাস্করে্য পুস্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন চবি বিভিন্ন অনুষদের ডিনবৃন্দ, চবি শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ, হলের প্রভোস্টবৃন্দ ও আবাসিক শিক্ষকবৃন্দ, প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টরবৃন্দ, বিভিন্ন বিভাগীয় সভাপতি, ইনস্টিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকবৃন্দ, অফিসার সমিতির নেতৃবৃন্দ, চবি ক্লাব (ক্যাম্পাস), সমন্বয় কর্মকর্তা বিএনসিসি, চবি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ, চবি, উস প্রাইমারি অ্যান্ড হাই স্কুল, কর্মচারী সমিতি ও কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক সমিতি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনসমূহ। আলোচনা অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলওয়াত করেন চবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব হাফেজ আবু দাউদ মুহাম্মদ মামুন, পবিত্র গীতা থেকে পাঠ করেন চবি রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ড. তাপসী ঘোষ রায়, পবিত্র ত্রিপিটক থেকে পাঠ করেন চবি ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা এবং পবিত্র বাইবেল থেকে পাঠ করেন চবি শিক্ষার্থী জনাব প্রিয়াংকা পিংকি।
দিনব্যাপী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ফজরের নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল মসজিদে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের স্ব স্ব উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। সকালে সূরে্যাদয়ের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ বছরের বিজয় দিবসে জুলাই বিপ্লব স্মরণে প্রত্যেকেই লাল ব্যাচ পরিধান করেন।