মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নাগরিকদের কারণে নতুন ভোটার হতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল চট্টগ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের। এবার সেই ভোগান্তি থেকে রেহাই মিলেছে। তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে চারটি কাগজ হলেই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবে নির্বাচন কমিশন। মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সকালে নির্বাচন কমিশনের ‘শিথিলবার্তা’ জানাতে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য জানান আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ইউনুচ আলী।
আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ইউনুচ আলী বলেন, ‘রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বিশেষ এলাকায় বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও ভীনদেশি কোন নাগরিক যেন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে না পারে। এছাড়া প্রকৃত বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তিসহ অন্যান্য সময় ভোটার তালিকা বা জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ সহজীকরণের লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচটি জেলা অর্থাৎ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এর সকল এলাকাকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি এসব বিশেষ এলাকার নাগরিকদের ভোটার নিবন্ধনের জন্য তিনটি (A,B,C) ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ এ (A) ও বি (B) ক্যাটাগরির মধ্যে যারা পড়বে তাদের চারটি ডকুমেন্টস অবশ্যই লাগবে। এছাড়াও, যারা সি (C) ক্যাটাগরিতে রয়েছেন তাদের ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম বিশেষ কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে।’
তিন ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে নাগরিকদের যেসব বৈধ কাগজ লাগবে—
এ (A) ক্যাটাগরি : এ (A) ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে নাগরিকদের এসএসসি-সমমান বা তদুর্ব্ধ সনদ থাকলে চারটি কাগজ প্রয়োজন হবে। এরমধ্যে এসএসসি-সমমান বা তদুর্ব্ধ অনলাইন সনদ, ভেরিফাইয়েবল কিউআর (QR) কোডযুক্ত অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ, ভেরিফাইয়েবল কিউআর (QR) কোডযুক্ত অনলাইন নাগরিকত্ব সনদ, বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র।
উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিজীবীর সন্তান ‘এ (A)’ ক্যাটাগরিভুক্ত হবে। এক্ষেত্রে সরকারি চাকবরির প্রমাণ স্বরুপ অফিসা প্রধানকর্তৃক সত্যায়িত সার্ভিস বহির কপি, নিয়োগপত্র, যোগদানপত্র দিতে হবে।
বি (B) ক্যাটাগরি : বি (B) ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে নাগরিকদের এসএসসি-সমমান বা তদুর্ব্ধ সনদ না থাকলে সাতটি কাগজ প্রয়োজন হবে। তবে চারটি জরুরি। এরমধ্যে ভেরিফাইয়েবল কিউআর (QR) কোডযুক্ত অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সনদ, ভেরিফাইয়েবল কিউআর (QR) কোডযুক্ত অনলাইন নাগরিকত্ব সনদ, বাবা-মায়ের এএফআইএস (Automated Fingerprint Identification System— AFIS) যাচাই, স্থায়ী বাসিন্দা সনদ, ভূমিহীন সনদ, অনলাইন ভেরিফাইয়েবল ভূমি উন্নয়ন কর দেওয়ার রশিদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), পাসপোর্ট (যদি থাকে), ড্রাইভিও লাইসেন্স (যদি থাকে)।
উল্লেখ্য, বাবা-মায়ের মধ্যে একজন বেঁচে থাকলে এবং তিনি ভোটার হয়ে থাকলে এএফআইএস (AFIS) যাচাই এবং অন্যজনের অনলাইন মৃত্য সনদ দাখিল কবরতে হবে। আর বাবা-মা কেউ বেঁচে না থাকলে উভয়ের অনলাইন মৃত্যু সনদ দাখিল করতে হবে।
সি (C) ক্যাটাগরি : বিশেষ এলাকার যে সকল বাসিন্দা ভোটার নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এ (A) ও বি (B) ক্যাটাগরি এর আওতায় পড়বে না; তাদের ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম বিশেষ কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে।
এ বিশেষ কমিটিতে থাকবেন কারা—
উপজেলা নির্বাচন অফিস : উপজেলা নির্বাচন অফিসের ক্ষেত্রে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবসহ মোট আটজনকে রাখা হয়েছে। এতে আহ্বায়ক হিসেবে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে (ইউএনওও), সদস্য সচিব হিসেবে উপজেলা নির্বাচন অফিসারকে রাখা হয়েছে। এছাড়াও সদস্য হিসেবে থাকবেন থানার অফিসার ইনচার্জ/পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত-অপারেশন)/সেকেন্ড অফিসার, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, হেডম্যান/কারবারী (পাবর্ত্য জেলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অথবা প্যানেল চেয়ারম্যান।
সিটি করপোরেশন বা মেট্রোপলিটন থানা নির্বাচন অফিস : সিটি করপোরেশন বা মেট্রোপলিটন থানা নির্বাচন অফিসের ক্ষেত্রে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবসহ মোট ছয়জনকে রাখা হয়েছে। এতে সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসারকে আহ্বায়ক ও থানা নির্বাচন অফিসারকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। এছাড়াও, সদস্য হিসেবে থাকবেন অফিসার ইনচার্জ/পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত-অপারেশন)/সেকেন্ড অফিসার, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর।
বিশেষ কমিটির কার্যপরিধি—
► বিশেষ তথ্য ফরমে প্রদত্ত সকল জাতীয় পরিচয়পত্রের এনআইডি নম্বরসমূহ অনলাইনে যাচাই করতে। যাচাইয়ের সময় নিম্নলিখিত বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ খেয়াল রাখতে হবে। (ক) ভাই/বোনের জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লিখিত পিতা/মাতার নামের সাথে আবেদনকারীর উল্লিখিত পিতা/মাতার নামের মিল থাকতে হবে। (খ) চাচা/ফুফুর ডাটাবেজে তাদের পিতার নাম ও ঠিকানার সাথে আবেদনকারীর বিশেষ তথ্য ফরমে প্রদত্ত পিতামহের নাম ও ঠিকানার মিল থাকতে হবে। (গ) প্রয়োজনে নিকট আত্মীয়ের মোবাইল নম্বরে কথা বলে তাদের পরিচিতি/তথ্য সম্পর্কিত বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।
► ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ অনুযায়ী ভোটার হতে ইচ্ছুক উপযুক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশের কোথাও ‘সচরাচর নিবাসী’ হতে হবে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জারিকৃত পরিপত্রে উল্লিখিত জেলাসমূহের যদি কেউ সচরাচর নিবাসী দাবি করে, তবে সেই দাবির যথার্থতা পুঙ্খানুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করতে হবে। শুধু একটি নিবাসের ঠিকানাই এ জন্য যথেষ্ট হবে না। নিবাসের প্রমাণস্বরূপ তাকে এ সংক্রান্ত প্রণীত অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ ফরম অনুযায়ী চাহিত সব তথ্য প্রদান করতে হবে।
► যদি বর্ণিত জেলাসমূহে এই সমস্ত ব্যক্তি নিজস্ব সম্পত্তির সূত্রে তালিকাভূক্তির দাবি করে তবে তাদের সম্পত্তির মালিকানা ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য সংশ্লিষ্ট দালিলাদি তথ্য সংগ্রহকারীকে প্রদান করতে হবে।
► যারা বাংলাদেশি কোনো নাগরিকের সাথে বৈবাহিক সূত্রে ভোটার তালিকাভুক্তির দাবি করবেন তাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত নাগরিক সনদপত্রসহ দলিলাদি তথ্য সংগ্রহকারীকে প্রদান করতে হবে এবং অন্য কোনো সূত্রে কেউ ভোটার হওয়ার উপযুক্ত দাবি করলে তাদেরকে এ সম্পর্কিত প্রমাণ তথ্য সংগ্রহকারীকে প্রদান করতে হবে।
► তথ্য সংগ্রহকারীগণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফরম-২ এর সাথে এ কার্যক্রমের আওতায় অতিরিক্ত তথ্য ফরম মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় দালিলিক কাগজপত্রসহ প্রতিটি কেস উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসারের নিকট জমা দিবেন। উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসার আবেদন/কেসসমূহের সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করে সকল কাগজপত্র বিশেষ কমিটির নিকট উপস্থাপন করতে হবে।
► বিশেষ কমিটি প্রতিটি ফরম পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে যাচাই বাছাইয়ের আগে সিদ্ধান্ত দেবেন। বাছাইকৃত কেসগুলোয় বিশেষ কমিটির ইতিবাচক সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসারকে অবহিত করার পর তিনি ওই সমস্ত নাগরিকদের ভোটার তালিকাভুক্ত করার জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণের আগে নিবন্ধন কেন্দ্রে তাদের আগমনের জন্য নোটিশ জারি করতে হবে। যাদের কেস গ্রহণ করা হবে না, কি কারণে গ্রহণ করা হলো না, তা নোট শিটে লিপিবদ্ধ করে বিশেষ কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর করতে হবে। এছাড়া নিষ্পত্তির বিষয়টি প্রতিটি বিশেষ তথ্য ফরম (ফরম-২ এর অতিরিক্ত তথ্য)-এর ১৬ নম্বর ক্রমিকে বিশেষ কমিটির সিদ্ধান্ত উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসার লিপিবদ্ধ করতে হবে।
► বিশেষ কমিটি যাদের আবেদন বাতিল করবে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর উক্ত বিষয়ে বিশেষ কমিটির সিদ্ধান্তের অনুলিপি নিয়ে সংশোধনকারী কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন কতে পারবেন।
► রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার বিষয়ে যদি কেউ তাদের সহযোগিতা অথবা মিথ্যা তথ্য প্রদান অথবা মিথ্যা/জাল কাগজপত্র সরবরাহ করেন অথবা সংশ্লিষ্ট কারো গাফিলতি পরিলক্ষিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০ এবং প্রচলিত অন্যান্য আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হবে।
জানা গেছে, রোহিঙ্গারা সমতলে ছড়িয়ে পড়ায় ২০১৯ সালে নির্বাচন কমিশন চট্টগ্রাম অঞ্চলের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার সব উপজেলাকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করে ইসি। ৩২টি উপজেলা/থানার ভোটারযোগ্য ব্যক্তিদের নিবন্ধনের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ‘বিশেষ কমিটি’ গঠন করা হয়। ওই কমিটির যাচাই-বাছাই এবং সুপারিশ প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়।