পানিতে একাকার চট্টগ্রাম শহর 

99
খাল, নালা-নর্দমা, বাসা ও সড়কে চারদিকে থই থই করছে পানি। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর, আবার কোথাও বুক ছুঁই ছুঁই পানি। কোথাও ঢেউ খেলছে, আবার কোথাও বইছে স্রোত। দৃশ্যত যেন এক বহমান নদী। যার ওপর দিয়ে চলছে রিকশা, অটোরিকশা এবং বাস-মিনিবাসসহ নানা যানবাহন। চলছে নৌকাও। সাঁতরিয়ে চলছে কর্মজীবী মানুষ। ভাসছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ ও ছোট-বড় বহুতল ভবন।গত তিন দিন থেকে চুলা জলছেনা চট্টগ্রাম শহরের অধিকাংশ বাসা বাড়ীতে।পানির জন্য বের হতে পারছে না সিটি মেয়র। সবমিলিয়ে নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ।আজ সোমবার বৃষ্টি বেশী হওয়ায় পানি আরো বেড়েছে নগরীতে।
রোববার দিনজুড়েই এমন দৃশ্য চোখে পড়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায়। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া টানা বর্ষণ নগরীর খুলশী ও অক্সিজেনের পাহাড়ি এলাকা ছাড়া ৪১ ওয়ার্ডের সবকটি এলাকায় এখন থই থই করছে পানি। এর মধ্যে গত শনিবার বিকাল থেকে নগরীর প্রাণকেন্দ্র রিয়াজ উদ্দিন বাজার পরিণত হয়েছে স্রোতঃস্বিনী নদীতে। আর চকবাজার যেন পরিণত হয় কক্সবাজারে।
এসব এলাকার দোকানপাট ও বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে নষ্ট হচ্ছে আসবাবপত্র। জ্বলছে না রান্নার চুলা। সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিল্প কারখানা খোলা থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন চাকরিজীবীরা। বাড়তি ভাড়া দাবি করছে রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকরা। উন্মুক্ত নালা ও ফুটপাথের ভাঙা স্ল্যাব পথচারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ উজ্জল কান্তি পাল জানান, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। রোববার রাতে চট্টগ্রামে সবছেয়ে বেশি  বৃষ্টি হয়। এতে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত ভারী বর্ষণ হতে পারে।
তিনি জানান, চার দিনের বৃষ্টিতে কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকা মোহরা, হামিদচর, চর রাঙামাটিয়া, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, বাদুরতলা, বহদ্দারহাট, বাস টার্মিনাল, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, খাজা রোড, মিয়াখাননগর, প্রবর্তক মোড়, মেহেদীবাগ, ষোলশহর ২ নং গেট, মুরাদপুর, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, ছোটপুল-বড়পুল, গোসাইলডাঙ্গা, বৃহত্তর হালিশহর এবং হালিশহরের অনেক এলাকা এখন পানির নিচে। খলিফাপট্টি থেকে শুরু করে শহরের মধ্যে উঁচু এলাকা হিসেবে পরিচিত নন্দনকাননের সড়কেও পানি জমেছে। এসব এলাকার প্রধান সড়কের কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর, আবার কোথাও বুক ছুঁই ছুঁই পানিতে তলিয়ে যায়। এসব এলাকার শত শত মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
সাজ্জাদ খান বলেন, নগরীর পশ্চিম ষোলশহর সুন্নিয়া মাদ্রাসা রোড, নাজির পাড়া, শ্যামলী আবাসিক, হাদু মাঝি পাড়া, দাম্মুয়া পুকুর পাড়,মীর বাড়ি, মোশাররফ আলীর বাড়ি,ফরিদা বাপের বাড়ি, ইমাম উদ্দিন মুন্সীর বাড়ি, সিদ্দিকের বাড়ি, ইসলাম কন্টাক্টর বাড়ি, মফজল আহম্মদ সাওদাগর বাড়ি, শুক্কুর সরদার,রসূল বক্স বাড়ি সহ মাদ্রাসার আসে পাশে অনেক ঘর বাড়ি দোকান পাঠ আজ চতুর্থ দিনের মতো এখোনো এক গলা থেকে এক কোমর পর্যন্ত পানির নিচে তলিয়ে আছে।
রিয়াজ উদ্দিন বাজার যখন স্রোতঃস্বিনী পদ্মা : চট্টগ্রামের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র রিয়াজ উদ্দিন বাজারে রয়েছে অন্তত ১০ হাজারেরও বেশি দোকানপাট। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার থেকে টানা বর্ষণে হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায় এই বাজার। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য এক রকম বন্ধ হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে দোকানপাটে পানি ঢুকে প্রচুর মালামাল নষ্ট হয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ তথ্য জানান রিয়াজ উদ্দিন ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনিস হায়দার। তিনি বলেন, প্রতি বছর বর্ষায় রিয়াজ উদ্দিন বাজারের অলিগলির সড়ক পানিতে ডুবলেও দোকানপাটে তেমন ঢুকেনি। কিন্তু এবার বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ারের পানি যোগ হওয়ায় দোকানপাটে পানি প্রবেশ করে। এতে হাজার হাজার দোকানের মালামাল পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে।
রিয়াজ উদ্দিন বাজার আমতলের কাপড়ের দোকানদার মো. সেলিম হোসেন বলেন, গত শনিবার বিকাল ৪টার দিকে হঠাৎ প্রবল স্রোত শুরু হয় রিয়াজ উদ্দিন বাজারের সড়কে। এ সময় আমার দোকানের অনেক কাপড়ের গাইড ভেসে যায়। এতে আমার কয়েক লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন সড়কের শত শত দোকান ডুবে গিয়ে মালামাল নষ্ট ও স্রোতের টানে ভেসে গেছে বলে জানান তিনি।
চকবাজার যখন কক্সবাজার : চট্টগ্রামের নিচু এলাকাগুলোর মধ্যে চকবাজার একটি। ফলে প্রতি বছর বর্ষায় সবার আগে ডুবে এই চকবাজার। তবে গত ৪-৫ বছর ধরে চকবাজারের জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। চলতি টানা বর্ষণেও গত তিন দিন ধরে এই চকবাজারে ঢেউ খেলছে পানি। যাকে কক্সবাজারের সঙ্গে তুলনা করছে সেখানকার ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। এই জলাবদ্ধতার জন্য চট্টগ্রাম মহানগর জাতীয় পার্টির স্বঘোষিত সভাপতি সোলায়মান শেঠকে দায়ী করে ব্যাপক ক্ষোভ ঝারেন স্থানীয়রা। আবুল বাশার নামে এক বাসিন্দা এই পোস্টের কমেন্টসে লিখেছেন-‘সোলায়মান শেঠ চকবাজারের মধ্য দিয়ে বহমান খাল দখল করে অভিজাত বহুতল মার্কেট ‘বালি আর্কেড’ নির্মাণের পর থেকে চকবাজার প্রতি বছর বর্ষায় হয়ে যাচ্ছে কক্সবাজার। এই দখলবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা যেন চট্টগ্রাম শহরের কারও নেই।’
অন্য এলাকার চিত্র : চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁও ওয়ার্ডের মোহরা এলাকার বাসিন্দা সরোয়ার মন্জু জানান, মোহরা আনার উল্লাহ শাহজী রোডে হাঁটুপানি জমে রয়েছে। এ ছাড়াও নাজিরবাড়ি, পুরান চান্দগাঁও, কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকা, বিসিক শিল্প এলাকা, চর রাঙামাটিয়া, হামিদচর আবাসিক এলাকা, টেকবাজার, বরিশাল এবং সিঅ্যান্ডবি এলাকাসহ আশপাশের এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। শত শত ঘরে পানি ঢোকায় রান্নাবান্না হয়নি।
হালিশহর এলাকার গৃহবধূ আখি সুলতানা জানান, বেশিরভাগ ভবনের নিচতলায় পানি ঢুকে গেছে। এতে রান্নাবান্নাসহ বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। শত শত মানুষ গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে। ফারজানা বেগম বলেন, শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ভাড়া গুনে স্কুলে যেতে হচ্ছে। ২০ টাকার রিকশা ভাড়া ১০০ টাকায় যেতে হচ্ছে। রাস্তায় হাঁটু ও কোমর পানি মাড়িয়ে বাসায় ফিরতে মেয়েদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর জানান, বৃষ্টির কারণে বলিরহাট, জেলেপাড়া, শীলপাড়া, বজ্রঘোনা, চেয়ারম্যান ঘাটা এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে শত শত বাড়িঘরে পানি ঢুকে রান্নাবান্না পর্যন্ত করা যাচ্ছে না। ক্ষোভ প্রকাশ করে ওয়ার্ড কাউন্সিলর এসরারুল হক বলেন, আমরা তো গলা পর্যন্ত ডুবছি! আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কি মাথাসহ ডুবে যাবে?
বিভিন্ন সড়কে পানি ওঠায় সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচল করছে। কোনো কোনো সড়কে যানবাহনে পানি ঢুকে ও গর্তে পড়ে বিকল হয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গুটিকয়েক স্থানে যানবাহন বদল করে চলাচল করলেও দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে। রাস্তায় যানবাহনের অভাবে শত শত লোক পানিতে সাঁতরিয়ে হাবুডুবু খেয়ে হেঁটে গন্তব্যে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে। অক্সিজেন এলাকার বাসিন্দা এহসান উল্লাহ জাহেদী জানান, সকালে বের হয়ে খাতুনগঞ্জ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সময় ষোলশহর ২নং গেট এলাকায় পানিতে আটকে পড়েন। কোমর পানির কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের না গিয়ে অগত্যা বাসায় ফিরে যান তিনি।
হাজী কামাল নামে এক ব্যবসায়ী জানান, বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল ও চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ১৪ সড়ক এলাকায় পানি ওঠায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এ সময় শত শত লোক পায়ে হেঁটে বহদ্দারহাট এলাকায় পৌঁছে। সেখান থেকে ১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা গুনে মুরাদপুর আসতে হয়। আবার সেখান থেকে আরও ২০ টাকা গুনে ষোলশহর ২নং গেটে এলাকায় পৌঁছাতে হয়। ইপিজেডের ভেতরে বৃষ্টির পানি হাঁটু ছাড়িয়ে গেছে জানিয়ে প্যাসিফিক জিন্সের কর্মরত মোহাম্মদ সুজন জানান, অনেক কষ্ট করে ইপিজেডের ভেতরের হাঁটু জল পেরিয়ে আগ্রাবাদ, লালখান বাজার হয়ে কর্নেলহাট এসেছি। অনেকে এখনও অফিসে আটকে আছে।
চট্টগ্রাম-হাটহাজারি সড়কের মুরাদপুর থেকে আতুরার ডিপো পর্যন্ত এবং কাপাসগোলা রোড, কেবি আমান আলী রোড, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের কে বি ফজলুল কাদের চৌধুরী রোড, প্রবর্তক মোড় এবং শুল্কবহরসহ প্রায় সব এলাকা জলমগ্ন বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্যম হালিশহর এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঢাকা ট্রাংক রোডে দুপুর ২টা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। বৃহত্তর হালিশহর ছাড়াও আগ্রাবাদ, বেপারিপাড়া, হাজিপাড়া, মোল্লাপাড়া, সিডিএ আবাসিক এলাকায় প্রধান সড়কগুলো কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। এসব বিভিন্ন এলাকায় ডিঙি নৌকায় মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছতে দেখা যায়।

 

Advertisement
spot_img
Advertisement
spot_img